যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও যাকাত হিসাব করার নিয়ম | ইসলামে এর ফযিলত

যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও যাকাত হিসাব করার নিয়ম

যাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ এবং এটি  আল্লাহর ইচ্ছার জন্য মুসলমানদের ধন-সম্পদ বিশুদ্ধ করার একটি উপায়। এটি এক চন্দ্র বছরের বেশি মালিকানাধীন সম্পদের উপর ভিত্তি প্রদান করতে হয়। কারণ ইসলামিক মাস চাঁদের উপর নির্ভর করে গণনা করা হয়। যাকাত মোট সম্পদের ২.৫% হিসাবে গণনা করা হয়। যাকাত দেওয়ার নিয়ম হল সংগৃহীত অর্থ প্রথমে যাকাত সংগ্রহকারীদের, তারপর দরিদ্র মুসলমানদের, ইসলামে নতুন ধর্মান্তরিতদের, ইসলামী যাজকদের এবং অন্যদের প্রদান করা হয়।

 

আমরা ছোটবেলায় যখন ইসলাম ধর্ম বই পড়তাম সেখানে লিখা থাকত যে, সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা ৫২ তোলা রূপা থাকলে তার উপর যাকাত দেওয়া ফরয। যাকাত দিলে ধনীদের সম্পদ গরীবদের মধ্যে বিতরিত হয়, এতে গরীবদের অবস্থার উন্নতি হয়।

 

যাকাত কি এবং ইসলামে এর ফযিলত কি?

ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও শান্তির বার্তা দেয়। এটি চায় যে তার অনুসারীরা অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করুক এবং বিশ্বকে আরও ভাল জায়গায় পরিণত করতে একে অপরকে সহায়তা করুক। বিশ্বকে আরও ভাল জায়গায় পরিণত করা এবং অন্যকে সাহায্য করা এটিই ইসলামের মূলমন্ত্র।

 

ইসলামে দান-খয়রাত এত বড় একটি স্থান দখল করে আছে যে, যা যাকাত আকারে পালন করার জন্য মুসলমানদের উপর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামে যাকাত অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এবং যারা যথেষ্ট ধনী, তাদের জন্য যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক।

 

যাকাত হল যাদের নিসাব পরিমাণ অর্থ আছে তাদের মাধ্যমে গরীবদের সাহায্য করার জন্য আল্লাহর প্রদত্ত মুসলমানদের উপর আরোপিত একটি নির্দেশ।

 

ইসলামে যাকাত হচ্ছে চতুর্থ স্তম্ভ। যাকাত সাধারণভাবে বিশুদ্ধিকরণ এবং বিশেষ করে সম্পদের পরিশোধনকে বোঝায়, সুতরাং, যে সমস্ত মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের চেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে, তারা যাকাত প্রদান করতে দায়বদ্ধ এবং যারা একটু কম অবস্থা সম্পন্ন, তাদের একটি আদর্শ উপায়ে তাদের জীবন যাপনের জন্য আল্লাহ এটি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

 

আজকের এই লিখায় যাকাত দেওয়ার নিয়ম এবং যাকাত হিসাব করার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, যাতে আপনারা সঠিকভাবে যাকাত কায়েম করতে পারেন।

 

যাকাত দেওয়ার নিয়ম

 

যাকাত দেওয়ার নিয়ম নিয়ে কথা শুরু করার আগে  একটি আয়াত দিয়ে শুরু করা যাক, “যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা উত্তম, আর যদি তোমরা তা গোপন কর এবং গরীবদেরকে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম। আর এতে করে তোমাদের কিছু মন্দ কাজ দূর হয়ে যাবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।” “[আল-কুরআন ২:২৭১]

 

আমরা সালাত যেমন গুরুত্ব সহকারে কায়েম করি যাকাত ও সেভাবে কায়েম করা উচিত।যাকাত পূরণের জন্য একটি অভিপ্রায় তৈরি করা বাধ্যতামূলক, ঠিক যেমন সালাহর জন্য একটি অভিপ্রায় তৈরি করা বাধ্যতামূলক। কোন , অভাবী ব্যক্তিকে (যাকে যাকাত দেওয়া হয়) যাকাত দেওয়া হলে তার কাছে তা প্রকাশ না করে যদি তাকে উপহার সরূপ সেই টাকা প্রদান করে যাকাতের নিয়াত করা হয়, তাতে ও যাকাত কায়েম করা হবে।

 

যাকাত কেবল তখনই বৈধ হবে যদি প্রাপককে সেই পরিমাণ অর্থের সম্পূর্ণ রূপে মালিক করা হয়। আপনি যদি  যাকাত হিসাবে  মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল,  কূপ, সেতু বা অন্য কোন জনসাধারণের সুবিধা নির্মাণ করে দেন তাহলে তা হবে না। যাকাত বিতরণের জন্য অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কর্তৃত্ব অর্পণ করা যেতে পারে যাতে এটি যাকাতের আইন অনুযায়ী ব্যবহার করা যায়।

 

যদি কোন এজেন্টকে যাকাত বিতরণের জন্য দেয়া হয় এবং সে তা বিতরণ না করে, তবে যাকাতকে পরিপূর্ণ বলে গণ্য করা হবে না এবং যাকাতের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন না করার পাপ তার উপর বোঝা হয়ে থাকবে।

 

কিসের উপর যাকাত দিতে হয়?

 

যাকাত  আপনার মাসিক আয়ের উপর নয় বরং আপনার  সম্পদের উপর ভিত্তি করে পরিশোধ করতে হবে। যদি আমরা ফয়সালের (আমাদের কাল্পনিক চরিত্র) উদাহরণ নিই, যিনি বছরে ২০,০০০ টাকা আয় করেন এবং তার বাৎসরিক সঞ্চয়ের পরিমাণ  ২০০ , তবে ফয়সালকে  তার বার্ষিক সঞ্চয়ে ২০০ টাকা থেকে তার যাকাত গণনা করতে হবে।

 

যাকাত কেবল আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে প্রদান করা হয় না। আপনাকে অন্যান্য ধরনের সম্পদের উপর যাকাত প্রদান করতে হয়, যেমন:

 

  • সোনা ও রূপা
  • বাড়িতে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা নগদ টাকা
  • স্টক এবং শেয়ারগুলি সরাসরি বা বিনিয়োগ তহবিলের মাধ্যমে মালিকানাধীন
  • অন্যের কাছে ধার দেওয়া টাকা
  • বাণিজ্য এবং পণ্যদ্রব্যে ব্যবসায়িক স্টক
  • কৃষিজাত পণ্য
  • গবাদি পশু যেমন গরু, ছাগল এবং ভেড়া
  • পেনশন
  • বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে মালিকানাধীন সম্পত্তি

 

একটি কমন জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন হ’ল মহিলাদের তাদের সোনা এবং রূপার গহনাগুলিতে যাকাত প্রদান করতে হবে কিনা। এই বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে:

 

কিছু বিশেষজ্ঞ  বলেছেন যে আপনাকে গহনা সহ সমস্ত সোনা এবং রূপার উপর (নিসাব স্তরের উপরে) যাকাত প্রদান করতে হবে। তবে আপনাকে প্ল্যাটিনামের মতো অন্যান্য মূল্যবান ধাতু বা হীরার মতো মূল্যবান পাথরের উপর যাকাত দিতে হবে না।

 

অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা  বলছেন যে যদি সোনার বা রূপার গহনা ব্যক্তিগত কারণে ডেইলি ইউজের জন্য পড়া হয় তাহলে সেই গহনা সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে না, এবং তার উপর যাকাত দিতে হবেনা।

 

আপনি যদি সম্পদ সংগ্রহের জন্য বা পরে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে গহনা কিনে থাকেন, তবে সেই গহনাটি আর নিছক অলঙ্কার হিসেবে বিবেচিত হবে না এর উপর আপনার যাকাত দিতে হবে।

 

আরেকটি  জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন হ’ল সম্পত্তি বা গাড়ির মতো মূল্যবান আইটেমগুলিতে যাকাত প্রদান করা দরকার কিনা। উত্তর হল না, এই আইটেমগুলি ছাড় দেওয়া হয়েছে।

 

যাকাত হিসাব করার নিয়ম

 

যাকাত হিসাব করা অনেক কঠিন একটি কাজ, কারণ অল্প একটু ভুল হলে আপনার গুনাহগার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

 

সোনা এবং রূপার যাকাত দেওয়ার নিয়ম

 

সোনা রূপার যাকাত হিসাব করার জন্য আপনাকে মার্কেটের সোনার ভরি এবং রূপার গ্রাম প্রতি দাম জেনে, তার সাথে আপনার যে পরিমাণ গহনা আছে, তা গুন দিয়ে বের করতে হবে, এতে যে দাম আসবে তার ২.৫% অর্থ আপনাকে যাকাত দিতে হবে।

 

 নগদ অর্থ বা ব্যাংকে জমা থাকা অর্থের যাকাত দেওয়ার নিয়ম

 

এটি হিসাব করা সহজ , আপনার যে পরিমাণ অর্থ থাকবে, তার ২.৫% অর্থ আপনাকে যাকাত দিতে হবে, অবশ্যই তা জমা থাকা অর্থ হতে হবে।

 

কৃষিজাত শস্যের যাকাত দেওয়ার নিয়ম

 

আপনাকে আপনার কাছে মজুদ থাকা শস্যের বাজার মূল্য জানতে হবে, আর সেই বাজার মূল্যের ২.৫% অর্থ আপনাকে যাকাত হিসেবে দিতে হবে।

মানে মুল কথা হল আপনাকে আপনার নিসাব পরিমাণ অর্থের ২.৫% যাকাত হিসেবে গণনা করতে হবে।

 

বর্তমানে অনেক ওয়েবসাইট আছে যা আপনাকে আপনার যাকাত হিসাব করতে সাহায্য করে, এমন কিছু ওয়েবসাইট হলঃ

 

মুসলিম এইড

মুসলিম হ্যান্ড

ফ্রি যাকাত ক্যালকুলেটর

এগুলো হল বহুল পরিচিত ওয়েবসাইট।

 

যাকাতের গুরুত্বঃ

 

একজন মুসলিম হিসেবে যাকাতের গুরুত্ব অনেক, এটি অর্থ সব ধরণের মানুষের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়াস চালায়।

 

সমাজ গঠনে সহায়তা করে

 

যাকাতের প্রথম সুবিধা হল এটি সমাজের যারা একটু অভাবী  তাদের সাহায্য করে। যদি সমাজের একশ্রেণীর মানুষ সব টাকা সংগ্রহ করতে থাকে এবং অন্য কাউকে কিছু না দেয়, তাহলে বাকিরাও একই দুর্দশার মধ্যে থাকবে এবং সমাজের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন শুরু হবে। অতএব, যখন সমাজের বিত্তবানরা যাকাত দেয়, তখন এর মানে হল যে যারা গরীব , তারা আরও ভালমানের জীবনযাত্রা উপভোগ করার সুযোগ পায়।

 

অর্থের প্রচলন

 

যাকাত হচ্ছে এক ধরনের দান-খয়রাত ,যার মাধ্যমে একজনের অর্থ বিভিন্ন মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থের প্রচলন ঘটে পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

 

ত্যাগের অনুভূতি বিকশিত করে

 

যাকাত ত্যাগের শিক্ষা দেয়। সম্পদ এমন একটি জিনিস যার প্রতি মানুষের মায়া বেশি। অতএব, যখন একজন ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে দান করে, তখন এর অর্থ হল যে সে তাদের ব্যক্তিগত মায়া ত্যাগ করে  সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ র আদেশকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং তাদের সাথে তাদের ত্যাগের মহিমা প্রকাশ পায়, আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়।

 

কাদেরকে যাকাত দেওয়া যায় ?

 

কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 

“দান-খয়রাত কেবল ফুকারা (গরীব) এবং আল-মাসাকিন (অভাবী) এবং যারা অর্থ সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত হয়েছে তাদের জন্য; এবং যারা [ইসলামের দিকে] ঝুঁকে পড়েছে তাদের হৃদয়কে আকৃষ্ট করার জন্য; এবং বন্দীদের মুক্ত করার জন্য; এবং যারা ঋণগ্রস্ত, তাদের জন্য; এবং আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরের জন্যও। আল্লাহর আরোপিত একটি কর্তব্য। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

 

কুরআনের এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে  নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা যাকাতের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারেঃ

 

  • গরীব- যাদের কাছে সাধারণভাবে জীবন যাপন করার ও ক্ষমতা নেই।
  • অভাবী – এই লোকেরাও দরিদ্র, তবে তারা তাদের দারিদ্র্যতা প্রকাশ করে না।
  • কালেক্টররা – এই লোকেরাই অন্য লোকেদের কাছ থেকে যাকাত সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে তারা নিজেরাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না।
  • যারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয় তারাও যাকাত প্রাপক হিসাবে যোগ্য, কারণ ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে তাদের জীবনের একটি নতুন সূচনার জন্য সহায়তা এবং সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
  • ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য – যাকাতের অর্থ দাসদের মুক্ত করার জন্যও ব্যয় করা যেতে পারে।
  • ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি  – যারা ঋণে জর্জরিত এবং ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারে না তারাও যাকাতের জন্য যোগ্য।
  • যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে
  • ভ্রমণকারীদের জন্য – যাকাত  ভ্রমণকারীদেরও দেওয়া যেতে পারে কারণ ভ্রমণের ব্যবস্থা করার সময় তাদের অর্থের প্রয়োজন হতে পারে।

 

শেষ কথা

আজকের এই লিখায় আপনারা যাকাত দেওয়ার নিয়ম এবং যাকাত হিসাব করার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল, এতে আশা করি আপনাদের যাকাত সম্পর্কে যাবতীয় সংশয় দূর হয়ে গেছে।

 

বিভিন্ন তথ্য পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটে সাথেই থাকুন। পাসপোর্ট করার নিয়ম ও খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন আমাদের এইখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!